আকাশ ভরা সূর্য তারা | Solar System 1st Chapter

আকাশ ভরা সূর্য তারা:
ভূমিকা:

এই অধ্যায়ে আমরা মহাবিশ্বের বিশালতা, এর অসংখ্য উপাদান, এবং আমাদের সৌরজগতের খুঁটিনাটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করবো। আমরা নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ, ধূমকেতু, এবং মহাকাশ গবেষণার বিষয়ে আরও জানবো।

১. মহাবিশ্বের বিশালতা (The Immensity of the Universe):

মহাবিশ্ব: মহাবিশ্ব হল এমন এক অসীম শূন্যস্থান যেখানে গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, ধূলিকণা, গ্যাস, এবং অন্যান্য অসংখ্য জ্যোতিষ্ক ভেসে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) মাধ্যমে।
ছায়াপথ (Galaxy): মহাবিশ্বের এক একটি ক্ষুদ্র অংশ হল ছায়াপথ। ছায়াপথে অসংখ্য নক্ষত্র, গ্যাস, ধূলিকণা, এবং অন্ধকার বস্তু (Dark Matter) সর্পিল (spiral) বা ডিম্বাকার (elliptical) পথে কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরতে থাকে।
আকাশগঙ্গা (Milky Way): আমাদের সৌরজগত যে ছায়াপথে অবস্থিত তার নাম আকাশগঙ্গা। এটি একটি সর্পিল ছায়াপথ, এবং এতে প্রায় ১০০-৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আমরা রাতের আকাশে যে উজ্জ্বল সাদা আলোর পটি দেখতে পাই, সেটাই আসলে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একটি অংশ।
আলোকবর্ষ (Light-year): মহাবিশ্বের বিশাল দূরত্ব পরিমাপের জন্য আলোকবর্ষ একক ব্যবহার করা হয়। আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে (প্রায় ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার বা 5.88 trillion miles) তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। এই বিশাল দূরত্ব কল্পনা করাও কঠিন!
নীহারিকা (Nebula): মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে, গ্যাস এবং ধূলিকণার বিশাল মেঘ তৈরি হয়েছিল। এই মেঘগুলোকেই নীহারিকা বলা হয়। নীহারিকা থেকেই নক্ষত্রের জন্ম হয়।

২. নক্ষত্রের জীবনচক্র (The Life Cycle of Stars):

নক্ষত্র: নক্ষত্র হল জ্বলন্ত গ্যাসীয় পিণ্ড, যাদের নিজস্ব আলো এবং উত্তাপ আছে। এই আলো ও তাপ উৎপন্ন হয় পারমাণবিক সংযোজন (Nuclear Fusion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়।
নক্ষত্রের জন্ম: নীহারিকার মধ্যে অভিকর্ষের টানে গ্যাস এবং ধূলিকণা জমাট বেঁধে নক্ষত্রের জন্ম হয়।
নক্ষত্রের রং: নক্ষত্রের রং তার তাপমাত্রা নির্দেশ করে।

  • লাল: সবচেয়ে কম উষ্ণ।
  • হলুদ: মাঝারি উষ্ণ।
  • সাদা: অত্যন্ত উষ্ণ এবং উজ্জ্বল।
  • নীল: প্রচণ্ড উষ্ণ এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল।

নক্ষত্রের মৃত্যু: নক্ষত্রের জ্বালানি (হাইড্রোজেন) শেষ হয়ে গেলে, নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে। ছোট নক্ষত্র ধীরে ধীরে শীতল হয়ে শ্বেত বামন (White Dwarf)-এ পরিণত হয়। বড় নক্ষত্রগুলি বিস্ফোরিত হয়ে সুপারনোভা (Supernova) তৈরি করে এবং শেষে নিউট্রন তারা (Neutron Star) অথবা কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole)-এ পরিণত হয়।
আমাদের সূর্য: সূর্য হল আমাদের নিকটতম নক্ষত্র এবং এটি একটি মাঝারি আকারের হলুদ তারা। এটি আমাদের থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
প্রক্সিমা সেনটাউরি: সূর্যের পরে আমাদের নিকটতম নক্ষত্র হল প্রক্সিমা সেনটাউরি, যা ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি একটি লাল বামন নক্ষত্র।

নক্ষত্রমণ্ডল (Constellation): রাতের আকাশে কাছাকাছি থাকা তারাগুলোকে কাল্পনিকভাবে যোগ করলে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি হয়। এরকম এক একটি তারার ঝাঁককে নক্ষত্রমণ্ডল বলে। যেমন:

  • সপ্তর্ষিমণ্ডল (Ursa Major/The Big Dipper): সাতটি উজ্জ্বল তারা, যা দেখতে অনেকটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত।
  • কালপুরুষ (Orion): একজন শিকারির মত কাল্পনিক আকৃতি।
  • ক্যাসিওপিয়া (Cassiopeia): ইংরেজি ‘M’ বা ‘W’ অক্ষরের মত।
  • ধ্রুবতারা (Polaris/North Star): উত্তর আকাশে অবস্থিত একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। ধ্রুবতারা প্রায় স্থির থাকে, তাই নাবিকেরা প্রাচীনকালে দিক নির্ণয়ের জন্য ধ্রুবতারা ব্যবহার করতেন।

৩. সৌরজগত (The Solar System):

সূর্য: সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি মাঝারি আকারের হলুদ তারা। এটি সৌরজগতের মোট ভরের প্রায় ৯৯.৮৬%।

গ্রহ ও সৌর জগতের গ্রহ সমুহ

গ্রহ: সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান জ্যোতিষ্ক, যাদের নিজস্ব আলো ও উত্তাপ নেই। গ্রহগুলি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে। সৌরজগতে মোট ৮টি গ্রহ রয়েছে:

  • বুধ (Mercury): সূর্যের নিকটতম এবং ক্ষুদ্রতম গ্রহ।
  • শুক্র (Venus): উষ্ণতম গ্রহ এবং পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ। একে সন্ধ্যাতারা বা শুকতারা বলা হয় কারণ সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে একে আকাশে দেখা যায়।
  • পৃথিবী (Earth): আমাদের আবাসস্থল। একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
  • মঙ্গল (Mars): লাল গ্রহ। এর মাটিতে প্রচুর পরিমাণে ফেরাস অক্সাইড (লৌহ) থাকায় এর রং লাল
  • বৃহস্পতি (Jupiter): সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ। এটি একটি গ্যাস জায়ান্ট।
  • শনি (Saturn): এর চারপাশে বলয় রয়েছে যা বরফ এবং পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি।
  • ইউরেনাস (Uranus): বরফের গ্রহ। মিথেন গ্যাসের উপস্থিতির কারণে এর রং হালকা সবুজ।
  • নেপচুন (Neptune): সৌরজগতের দূরতম গ্রহ। এটিও একটি বরফের গ্রহ। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড।

গ্রহের গতি

  • আবর্তন (Rotation): গ্রহগুলি নিজেদের অক্ষের চারপাশে ঘোরে। পৃথিবীর আহ্নিক গতি প্রায় ২৪ ঘণ্টা
  • পরিক্রমণ (Revolution): গ্রহগুলি সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। পৃথিবীর বার্ষিক গতি প্রায় ৩৬৫ দিন।

বামন গ্রহ (Dwarf Planet): গ্রহের মতই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, কিন্তু আকৃতিতে গ্রহের থেকে অনেক ছোট। গ্রহের সংজ্ঞার সব বৈশিষ্ট্য এদের নেই। যেমন: প্লুটো, সেরেস।

সূর্যের গঠন:

  • করোনা (Corona): সূর্যের বাইরের স্তর। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায়।
  • সৌরকলঙ্ক (Sunspots): সূর্যের অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণ অঞ্চল।
  • সৌরঝড় (Solar Flares): সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন শক্তিশালী বিকিরণ। সৌরঝড় পৃথিবীর কৃত্রিম উপগ্রহ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ক্ষতি করতে পারে।
    গ্রহের গতি:

 

৪. উপগ্রহ (Satellites):

উপগ্রহ: গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান জ্যোতিষ্ক, যাদের নিজস্ব আলো ও উত্তাপ নেই।
চাঁদ: পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব প্রায় ৩,৮৪,০০০ কিলোমিটার।
চাঁদের কলা (Lunar Phases): পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তনের ফলে চাঁদের আলোকিত অংশের যে পরিবর্তন দেখা যায়, তাকে চাঁদের কলা বলে।
অমাবস্যা (New Moon): চাঁদ যখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে থাকে।
পূর্ণিমা (Full Moon): পৃথিবী যখন চাঁদ ও সূর্যের মাঝে থাকে।
অন্যান্য গ্রহের উপগ্রহ:
মঙ্গল: ফোবোস, ডেইমোস
বৃহস্পতি: গ্যানিমেড (সৌরজগতের বৃহত্তম উপগ্রহ), ইউরোপা, আইয়ো, ক্যালিস্টো (মোট ৭৯টি)
শনি: টাইটান (বৃহস্পতির গ্যানিমেডের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম), এনসেলাডাস (মোট ৮২টি)
ইউরেনাস: মিরান্ডা, এরিয়েল (মোট ২৭টি)
নেপচুন: ট্রাইটন (মোট ১৪টি)

৫. অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তু:

গ্রহাণুপুঞ্জ (Asteroid Belt): মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মাঝে অবস্থিত অসংখ্য ছোট ছোট পাথুরে জ্যোতিষ্ক।
ধূমকেতু (Comet): বরফ, ধূলিকণা এবং গ্যাসের তৈরি জ্যোতিষ্ক, যা সূর্যের কাছে আসলে লম্বা ঝাঁটার মত লেজ তৈরি করে।
হ্যালির ধূমকেতু: প্রতি ৭৬ বছর পর পর দেখা যায়।
উল্কা (Meteor) এবং উল্কাপিন্ড (Meteorite): মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করা ছোট ছোট পাথর। বায়ুর ঘর্ষণে জ্বলে উঠলে তাকে উল্কা বলে। পৃথিবীর মাটিতে এসে পড়লে তাকে উল্কাপিন্ড বলে।

৬. মহাকাশ গবেষণা (Space Exploration):

টেলিস্কোপ (Telescope): দূরের জিনিস দেখার যন্ত্র। মানমন্দির (Observatory)-এ টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়।
কৃত্রিম উপগ্রহ (Artificial Satellite): মানুষের তৈরি উপগ্রহ যা পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। যোগাযোগ, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, এবং পৃথিবীর ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়।
মহাকাশ অভিযান:
ইসরো (ISRO): ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
আর্যভট্ট: ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ।
চন্দ্রযান-১: ভারতের প্রথম চন্দ্রাভিযান।
মঙ্গলযান: ভারতের প্রথম মঙ্গলগ্রহ অভিযান।
প্রথম মহাকাশচারী: ইউরি গ্যাগারিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন)।
প্রথম মহিলা মহাকাশচারী: ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা (সোভিয়েত ইউনিয়ন)।
প্রথম চাঁদে অবতরণ: নীল আর্মস্ট্রং এবং এডুইন অলড্রিন (অ্যাপোলো ১১ মিশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)।

উপসংহার:

এই অধ্যায়ের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের বিশালতা, এর বিভিন্ন উপাদান, এবং আমাদের সৌরজগত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করলাম। মহাকাশ গবেষণা আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও জানতে সাহায্য করছে এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন আবিষ্কারের সম্ভাবনা উন্মোচন করছে।

Leave a Comment