Class VI, Concept of History Chapter 1 | ইতিহাসের ধারণা

WBBSE Class Viএর ইতিহাস বিষয়ের প্রথম অধ্যায় হল  ইতিহাসের ধারণা । অধ্যায়টি বেশ বড় ও তথ্যবহুল । তাই এই অধ্যায়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সহযোগে  সংক্ষিপ্ত আকারে দেওয়া হল । আরও প্রশ্নও উত্তর, ক্যুইজ আলোচনা ও দেওয়া হয়েছে ।

ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক ধারাবাহিক ও বিজ্ঞানসম্মত বিবরণ। এটি কেবল অতীতের ঘটনাপঞ্জি নয়, বরং অতীতের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপনের একটি মাধ্যম। এই অধ্যায়ে আমরা ইতিহাসের ধারণা, ইতিহাসের উপাদান, ইতিহাসের সময়কাল বিভাজন, এবং ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

১. ইতিহাস কী?

ইতিহাস হল অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার, মানুষের জীবন ও কর্ম, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির, এবং তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধারাবাহিক বিবরণ। ইতিহাস অতীতের আয়না, যা আমাদের বর্তমানকে বুঝতে সাহায্য করে এবং ভবিষ্যতের পথ দেখায়। ইতিহাস রচনার মূল উদ্দেশ্য হল অতীতের ঘটনা সম্পর্কে সত্য অনুসন্ধান করা এবং তা নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা।

গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক সমুহ 

২. ইতিহাসের উপাদান:

ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করেন। এই উপাদানগুলোকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

(ক) লিখিত উপাদান:

বিভিন্ন লিখিত নথি: রাজাদের আদেশনামা, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, সরকারি নথিপত্র ইত্যাদি।
সাহিত্যকর্ম: প্রাচীন যুগের রচিত বিভিন্ন সাহিত্যগ্রন্থ, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, জাতকের গল্প, ইত্যাদি।
শিলালিপি: পাথরের গায়ে খোদাই করা লেখা।
তাম্রলিপি: তামার পাতে খোদাই করা লেখা।
মুদ্রা: প্রাচীন মুদ্রা, যাতে রাজার নাম, সময়কাল, এবং বিভিন্ন প্রতীক খোদাই করা থাকে।
দিনলিপি: ব্যক্তিবিশেষের দৈনন্দিন জীবনের বিবরণ।
জীবনী গ্রন্থ: বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীর বিবরণ।
ভ্রমণ কাহিনী: দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত।
বিদেশী বিবরণ: বিদেশী পর্যটক ও লেখকদের লেখায় প্রাপ্ত তৎকালীন সমাজের বিবরণ।

(খ) অলিখিত উপাদান / প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান:

মানুষের ব্যবহার করা জিনিসপত্র: হাতিয়ার, বাসনপত্র, অলংকার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি।
স্থাপত্য: ঘরবাড়ি, মন্দির, মসজিদ, প্রাসাদ, দুর্গ, ইত্যাদি।
ভাস্কর্য: পাথর, ধাতু, বা অন্য কোন বস্তু দিয়ে তৈরি মূর্তি।
চিত্রকলা: গুহাচিত্র, দেয়ালচিত্র, পুঁথিচিত্র ইত্যাদি।
জীবাশ্ম: মানুষ, জীবজন্তু, ও উদ্ভিদের দেহাবশেষ।
সমাধিক্ষেত্র: সমাধিক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত কঙ্কাল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি।
এই উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিকরা অতীতের ঘটনা, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।

৩. ইতিহাসের সময়কাল বিভাজন:

মানুষের জীবনের ইতিহাসকে সুবিধার জন্য ঐতিহাসিকরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হল:

(ক) প্রাগৈতিহাসিক যুগ (Pre-historic Period):

এই যুগে মানুষ লিখতে শেখেনি।

  • এই যুগের ইতিহাস জানতে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভর করতে হয়।
  • এই যুগে মানুষ পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত।
  • গুহায় বাস করত, শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করত।

এই যুগকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়:

  • পুরনো প্রস্তর যুগ (Paleolithic Age): পাথরের তৈরি অস্ত্র ছিল অমসৃণ ও ভারি।
  • মাঝের প্রস্তর যুগ (Mesolithic Age): পাথরের তৈরি অস্ত্র ছিল মসৃণ ও হালকা।
  • নতুন প্রস্তর যুগ (Neolithic Age): মানুষ কৃষিকাজ শিখেছিল, হাতিয়ার মসৃণ ও তীক্ষ্ণ ছিল, স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল।

(খ) প্রায়-ইতিহাসিক যুগ (Proto-historic Period):

এই যুগে মানুষ লিখতে শিখলেও সেই লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদাহরণ: সিন্ধু সভ্যতা।

(গ) ঐতিহাসিক যুগ (Historic Period):

যখন থেকে মানুষ লিখতে শিখল এবং সেই লেখার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তখন থেকে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা।
এই যুগের ইতিহাস লিখিত উপাদানের মাধ্যমে জানা যায়।
এই যুগে মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন, শিল্প, বাণিজ্য, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, নগর সভ্যতা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছিল।

৪. সময় গণনা:

ইতিহাসে সময় গণনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়কে বোঝার জন্য আমরা সাল, অব্দ, দশক, শতাব্দী, সহস্রাব্দ ইত্যাদি ব্যবহার করি।

  • সাল: কোন নির্দিষ্ট বছরকে সাল বলা হয়।
  • অব্দ: কোন নির্দিষ্ট অব্দ বা সময়কাল থেকে বছরের গণনা।
  • দশক: ১০ বছরের সময়কাল।
  • শতাব্দী: ১০০ বছরের সময়কাল।
  • সহস্রাব্দ: ১০০০ বছরের সময়কাল।

খ্রিস্টপূর্ব (BC) এবং খ্রিস্টাব্দ (AD) হল সময় গণনার দুটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি।

খ্রিস্টপূর্ব (BC – Before Christ): যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বের সময়কালকে খ্রিস্টপূর্ব বলা হয়। খ্রিস্টপূর্বাব্দ যত বেশি হবে, ঘটনাটি তত পুরনো।
খ্রিস্টাব্দ (AD – Anno Domini): যিশু খ্রিস্টের জন্মের পর থেকে যে সময়কাল গণনা করা হয়, তাকে খ্রিস্টাব্দ বলা হয়। AD-কে “In the year of our Lord”-ও বলা হয়।

৫. ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা:

ইতিহাস পাঠের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। ইতিহাস পড়ে আমরা:

অতীত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি: অতীতের ঘটনা, মানুষের জীবন, তাদের চিন্তাভাবনা, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারি।
বর্তমানের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারি: বর্তমানের অনেক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উৎস অতীতে নিহিত। ইতিহাস পাঠ করলে আমরা বর্তমানকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি: অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।
দেশ ও জাতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করি: ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশ ও জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সংগ্রাম ও অর্জন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি, যা আমাদের দেশাত্মবোধকে জাগ্রত করে।
মানুষ হিসেবে উন্নত হতে পারি: ইতিহাস পাঠ করলে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, চিন্তাশক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা উন্নত হয়, এবং আমরা আরও ভালো ও বিবেকবান মানুষ হতে পারি।
নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি পায়: ইতিহাসের মহৎ ব্যক্তিদের জীবন ও কর্ম আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ: বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি।

উপসংহার:

ইতিহাস শুধুমাত্র অতীতের শুষ্ক ঘটনাবলীর বিবরণ নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত ও গতিশীল বিষয় যা আমাদের বর্তমানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা আমাদের  অতীতকে জানতে পারি, বর্তমানকে সঠিকভাবে বুঝতে পারি এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনা তৈরি করতে পারি। তাই, আমাদের সকলের উচিত মনোযোগ সহকারে ইতিহাস পাঠ করা এবং এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে নিজেদেরকে উন্নত করা। এই জ্ঞান আমাদের জীবনে চলার পথে পাথেয় হবে।

Leave a Comment