প্রাচীন ভারতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি – এক ঝলক (সারসংক্ষেপ)
‘প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিচর্চার নানাদিক’ অধ্যায়ের মূল বিষয়বস্তু, যেমন গুরুকুল শিক্ষা, কালিদাসের সাহিত্য, আর্যভট্টের গণিত, অজন্তার চিত্রকলা এবং গান্ধার ও মথুরা শিল্পরীতি, সহজ ভাষায় আলোচনা।
ভূমিকা: সংস্কৃতির নানা রূপ
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশ শুধু রাজনৈতিক উত্থান-পতন বা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্যই পরিচিত ছিল না, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গেছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক বিকাশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা
প্রাচীন ভারতে গুরুকুল ছিল শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। ছাত্ররা গুরুর আশ্রমে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত। বেদ, উপনিষদ, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ধনুর্বিদ্যা ইত্যাদি ছিল পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা, বল্লভীর মতো বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলি দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত। শিক্ষা ছিল মূলত মৌখিক এবং স্মৃতিশক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত।
সাহিত্য সম্ভার
এই যুগে সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ও তামিল ভাষায় অমূল্য সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্য, বিভিন্ন পুরাণ এবং কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’, ‘মেঘদূতম্’-এর মতো কালজয়ী কাব্য ও নাটক। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ ও বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ ও ‘কাদম্বরী’ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বৌদ্ধদের ত্রিপিটক ও জাতকের গল্প পালি ভাষায় এবং জৈনদের আগম সূত্রগুলি প্রাকৃত ভাষায় রচিত। দক্ষিণ ভারতে সংগম সাহিত্য তামিল ভাষার গৌরব বৃদ্ধি করেছিল।
বিজ্ঞান ও গণিতের অগ্রগতি
প্রাচীন ভারতীয়রা গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছিল। শূন্য (০) এবং দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন ছিল তাদের শ্রেষ্ঠ অবদান। আর্যভট্ট পৃথিবীর আবর্তন, গ্রহণ এবং পাই (π)-এর মান নির্ণয় করেছিলেন। বরাহমিহির ও ব্রহ্মগুপ্তও ছিলেন খ্যাতনামা গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আয়ুর্বেদ ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। চরক সংহিতা (কায়চিকিৎসা) ও সুশ্রুত সংহিতা (শল্যচিকিৎসা) এই শাস্ত্রের দুটি প্রধান গ্রন্থ। ধাতুবিদ্যাতেও তারা পারদর্শী ছিলেন, যার প্রমাণ দিল্লির মরচেহীন লৌহস্তম্ভ।
শিল্পকলা ও স্থাপত্য
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পেও প্রাচীন ভারত উচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। মৌর্যযুগে নির্মিত পালিশ করা অশোক স্তম্ভ ও তার সিংহচতুর্মুখ শীর্ষ, এবং সাঁচির মতো বিশাল স্তূপ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে কুষাণ যুগে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রিক-রোমান প্রভাবে গান্ধার শিল্পরীতি এবং মথুরায় দেশীয় রীতিতে মথুরা শিল্পরীতির বিকাশ ঘটে, যেখানে বুদ্ধ ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করা হয়। গুপ্তযুগকে ভারতীয় শিল্পের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এই সময়ে দেওগড়ের দশাবতার মন্দিরের মতো পাথরের মন্দির নির্মাণ শুরু হয় এবং সারনাথের বুদ্ধমূর্তির মতো অনবদ্য ভাস্কর্য তৈরি হয়। অজন্তা ও বাঘ গুহার দেওয়ালচিত্র বিশ্বশিল্পের অমূল্য সম্পদ। এছাড়া, শিলাকর্তিত চৈত্য, বিহার এবং দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যও এই যুগের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরিচায়ক।
প্রাচীন ভারতের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরবর্তীকালের ভারত তথা বিশ্ব সভ্যতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।