‘অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা’ অধ্যায়ের মূল বিষয়বস্তু, যেমন প্রাচীন ভারতের কৃষি, বিভিন্ন শিল্প, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য, মুদ্রার প্রচলন এবং গিল্ডের ভূমিকা, সহজ ভাষায় আলোচনা।
ভূমিকা: জীবনধারণের নানা দিক
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই দীর্ঘ সময়ে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য এবং মুদ্রাব্যবস্থা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে, যা তৎকালীন সমাজকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছে।
অর্থনীতির মূল ভিত্তি: কৃষি ও পশুপালন
প্রাচীন ভারতে অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি। সিন্ধু-গঙ্গা উপত্যকার উর্বর জমিতে ধান, গম, যব, আখ, তুলা ইত্যাদি প্রধান ফসল হিসেবে চাষ করা হত। কৃষিকাজে লোহার লাঙলের ব্যবহার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। জলসেচের জন্য কূপ, পুকুর, খাল ও জলাধারের ব্যবহারও দেখা যায়। কৃষির পাশাপাশি পশুপালন ছিল জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। গরু, বলদ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু চাষের কাজে এবং দুধ-মাংসের জন্য পালন করা হত। রাষ্ট্র কৃষকদের থেকে উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ (সাধারণত এক-ষষ্ঠাংশ) ‘ভাগ’ বা ভূমিরাজস্ব হিসেবে আদায় করত।
শিল্প ও কারিগরি
এই যুগে বিভিন্ন হস্তশিল্পেরও বিকাশ ঘটেছিল। বস্ত্রশিল্পে ভারত ছিল অগ্রগণ্য; সূক্ষ্ম সুতি ও রেশমবস্ত্রের জন্য মথুরা, বারাণসী, বাংলা ও দক্ষিণ ভারত বিখ্যাত ছিল। ধাতুশিল্পে লোহা, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও রুপার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। এছাড়া মৃৎশিল্প, কাষ্ঠশিল্প, মণিমুক্তার কাজ, হাতির দাঁতের কাজ এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পও যথেষ্ট উন্নত ছিল। কারিগররা নিজেদের সমিতি বা ‘শ্রেণি’ (গিল্ড) গঠন করত, যা তাদের স্বার্থরক্ষা করত এবং উৎপাদিত দ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণ করত।
বাণিজ্য ও মুদ্রা
প্রাচীন ভারতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। উত্তর ভারতের ‘উত্তরাপথ’ এবং উত্তর থেকে দাক্ষিণাত্যের ‘দক্ষিণাপথ’ ছিল দুটি প্রধান স্থল বাণিজ্যপথ। গঙ্গা ও অন্যান্য নদীর মাধ্যমেও বাণিজ্য চলত। সমুদ্রপথে রোমান সাম্রাজ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তাম্রলিপ্ত, ভৃগুকচ্ছ (বারিগাজা), মুজিরিস, অরিথমেডু ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ভারত থেকে মশলা, বস্ত্র, দামি পাথর, মুক্তা, সুগন্ধি দ্রব্য ইত্যাদি রপ্তানি হত এবং সোনা, রুপা, মদ, কাঁচ ইত্যাদি আমদানি করা হত।
প্রথমদিকে জিনিসপত্রের পারস্পরিক আদানপ্রদান বা বার্টার প্রথা চালু থাকলেও, পরবর্তীকালে মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে আহত মুদ্রা (Punch-marked coins) প্রচলিত হয়। কুষাণরা প্রচুর সোনার মুদ্রা এবং সাতবাহনরা সিসা, পোতিন ও রুপার মুদ্রা চালু করে। গুপ্তযুগে উন্নতমানের সোনার মুদ্রা (দিনার) ও রুপার মুদ্রা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।
জীবনযাত্রা
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ছিল মূলত গ্রামকেন্দ্রিক ও কৃষিনির্ভর। নগরগুলি ছিল শিল্প, বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। সমাজে বর্ণভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল এবং বিভিন্ন পেশার মানুষের সামাজিক মর্যাদা ভিন্ন ছিল। গিল্ডগুলি কারিগর ও বণিকদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই সময়ের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা পরবর্তী ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।