ভারত ও সমকালীন বহির্বিশ্ব: সারাংশ Class VI History Chapter 9

‘ভারত ও সমকালীন বহির্বিশ্ব’ অধ্যায়ের মূল বিষয়বস্তু, যেমন বিভিন্ন বিদেশি জাতির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, সিল্ক রুটের ভূমিকা এবং বৌদ্ধধর্মের বিশ্বব্যাপী বিস্তার, সহজ ভাষায় আলোচনা।

ভূমিকা: প্রাচীন ভারতের বিশ্ব সংযোগ

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ শুধুমাত্র নিজের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ভারত তার সমকালীন বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে লিপ্ত ছিল। এই যোগাযোগ ভারতের সভ্যতাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও ভারতীয় সংস্কৃতির ছাপ ফেলেছে।

পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক: পারস্য, গ্রিস ও রোম

ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারস্যের (ইরান) একামেনিড সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার প্রভাবে স্থাপত্য ও লিপিতে (খরোষ্ঠী) পারসিক ছাপ দেখা যায়। পরবর্তীকালে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-৩২৫ অব্দ) স্বল্পস্থায়ী হলেও, এর ফলে গ্রিক ও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই যোগাযোগের পথ ধরেই পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে ইন্দো-গ্রিক রাজাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা মুদ্রাব্যবস্থা ও শিল্পকলায় নতুন মাত্রা যোগ করেন।

রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের অত্যন্ত লাভজনক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সমুদ্রপথে মশলা, বস্ত্র, মুক্তা, দামি পাথর ভারত থেকে রোমে রপ্তানি হত এবং বিনিময়ে রোম থেকে সোনা, রুপা ও অন্যান্য সামগ্রী আসত। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন বন্দর (যেমন অরিকা্মেডু, মুজিরিস) এই বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

উত্তর ও পূর্বের সঙ্গে সংযোগ: মধ্য এশিয়া, চিন ও সিল্ক রুট

মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন যাযাবর গোষ্ঠী যেমন শক, পহ্লব ও কুষাণরা ভারতে প্রবেশ করে এবং সাম্রাজ্য স্থাপন করে। কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের সময়ে সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং বিখ্যাত সিল্ক রুট বা রেশম পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর মধ্যে পড়ত। এই পথ ধরে শুধু রেশমই নয়, বিভিন্ন পণ্য ও ভাবধারার আদানপ্রদান চলত।

চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল মূলত বৌদ্ধধর্ম ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক। বহু চিনা পরিব্রাজক (যেমন ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ) বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সংগ্রহ ও তীর্থদর্শনের জন্য ভারতে এসেছিলেন। ভারত থেকেও বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পণ্ডিতরা চিনে গিয়ে ধর্ম ও দর্শন প্রচার করেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় প্রভাব: সুবর্ণভূমি

প্রাচীন ভারতীয়রা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ‘সুবর্ণভূমি’ বা ‘সুবর্ণদ্বীপ’ বলত। এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের গভীর বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ভারতীয় বণিক, ধর্মপ্রচারক ও রাজপুত্ররা সেখানে গিয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত ভাষা, ভারতীয় লিপি, শিল্পকলার প্রসার ঘটান। কম্বোডিয়া, জাভা, সুমাত্রা, শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড) প্রভৃতি অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে শক্তিশালী রাজ্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন (যেমন আঙ্কোরভাট, বোরোবুদুর) গড়ে ওঠে।

সাংস্কৃতিক বিনিময়

এই আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ফলে শুধুমাত্র বাণিজ্যই নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলার, ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক আদানপ্রদান ঘটেছিল। গান্ধার শিল্পে গ্রিক-রোমান প্রভাব, ভারতীয় গণিত (শূন্য, দশমিক) ও জ্যোতির্বিদ্যার পশ্চিমে বিস্তার, এবং বৌদ্ধধর্মের বিশ্বব্যাপী প্রসার এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এভাবেই প্রাচীন ভারত বিশ্ব সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।

Leave a Comment

Ask