WBBSE এর ষষ্ঠ শ্রেণীর পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয়ের প্রথম অধ্যায়: পরিবেশ ও জীবজগতের পারষ্পরিক নির্ভরতা । অন্যতম একটি বড় অধ্যায়। এই অধ্যায়টিকে তথ্য বহুল অথচ সংক্ষিপ্ত করে তোমাদের সামনে উপস্থাপিত করলাম ।
এই অধ্যায়ে আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ এবং পরিবেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জীব একে অপরের উপর কীভাবে নির্ভরশীল সে সম্পর্কে জানবো। জীব ও জড় উপাদান নিয়েই আমাদের পরিবেশ গঠিত। পরিবেশে জীবের বেঁচে থাকা, খাদ্য গ্রহণ, এবং একে অপরের সাথে সম্পর্ক এই অধ্যায়ের মূল আলোচ্য বিষয়।
১. পরিবেশের উপাদান:
আমাদের চারপাশের সব জৈব ও অজৈব জিনিস নিয়ে তৈরি হয়েছে পরিবেশ। পরিবেশের উপাদানগুলোকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
সজীব উপাদান (biotic factors): পরিবেশের সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ। যেমন: মানুষ, গরু, ছাগল, মাছ, পাখি, গাছপালা, শ্যাওলা, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।
জড় উপাদান (abiotic factors): পরিবেশের সমস্ত প্রাণহীন উপাদান। যেমন: মাটি, জল, বায়ু, আলো, উত্তাপ, পাথর, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি।
সজীব উপাদান তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদান জড় পরিবেশ থেকে গ্রহণ করে। যেমন, উদ্ভিদ মাটি থেকে জল ও খনিজ লবণ শোষণ করে, বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং সূর্যের আলোর সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। আবার, প্রাণী শ্বাস নেওয়ার জন্য বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে।
২. খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক:
বেঁচে থাকার জন্য সকল জীবেরই খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য গ্রহণের ভিত্তিতে পরিবেশে জীবের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাকে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক বলে।
খাদক (Consumer): যেসব জীব অন্য জীবকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের খাদক বলে।
খাদ্য (Prey): খাদক যে জীবকে ভক্ষণ করে, তাকে খাদ্য বলে।
উৎপাদক (Producer): সবুজ উদ্ভিদ, যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে, তাদের উৎপাদক বলে। এরা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে, মাটি থেকে গৃহীত জল ও খনিজ লবণ এবং বায়ু থেকে গৃহীত কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরি করে।
৩. বিভিন্ন শ্রেণীর খাদক:
খাদ্যাভ্যাসের উপর ভিত্তি করে পরিবেশে প্রাণীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যা এই অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে:
তৃণভোজী (Herbivores): যে সকল প্রাণী উদ্ভিদ ও উদ্ভিদের অংশ, যেমন পাতা, ঘাস, ফলমূল, ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে, তাদের তৃণভোজী প্রাণী বলে। উদাহরণ: গরু, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, খরগোশ, হাতি, জিরাফ, ঘোড়া, মেষ, গন্ডার, ঘাসফড়িং, ঝিঁঝি পোকা, প্রজাপতি, ইত্যাদি।
মাংসাশী (Carnivores): যে সকল প্রাণী অন্য প্রাণীদের (প্রধানত তৃণভোজী প্রাণীদের) মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে, তাদের মাংসাশী প্রাণী বলে। উদাহরণ: বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, শেয়াল, সাপ, ব্যাঙ, বাজপাখি, চিল, ঈগল, কুমির, হাঙর, ইত্যাদি।
সর্বভুক (Omnivores): যে সকল প্রাণী উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়কেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের সর্বভুক প্রাণী বলে। উদাহরণ: মানুষ, ভালুক, শূকর, ইঁদুর, ছুঁচো, কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, সজারু, মুরগি, কাক, শালিক, ময়ূর, পিঁপড়ে, তেলাপোকা, ইত্যাদি।
মৃতজীবী (Scavengers): যে সকল প্রাণী মৃত প্রাণীদের দেহাবশেষ, পচা গলা অংশ খেয়ে বেঁচে থাকে, তাদের মৃতজীবী প্রাণী বলে। উদাহরণ: শকুন, শিয়াল, হায়েনা, কিছু প্রজাতির কাক, ইত্যাদি।
পরজীবী (Parasites): যে সকল প্রাণী জীবিত অন্য প্রাণীর (পোষক) দেহে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সেই পোষক জীবের দেহ থেকে পুষ্টিরস শোষণ করে বেঁচে থাকে, তাদের পরজীবী বলে। উদাহরণ: গোলকৃমি, ফিতাকৃমি, উকুন, এঁটুলি, মশা, জোঁক, ইত্যাদি।
বহিঃপরজীবী: পোষক দেহের বাইরে বাস করে। যেমন: উকুন, এঁটুলি, মশা।
অন্তঃপরজীবী: পোষক দেহের ভেতরে বাস করে। যেমন: গোলকৃমি, ফিতাকৃমি।
৪. খাদ্য শৃঙ্খল ও খাদ্য জাল:
খাদ্য শৃঙ্খল (Food Chain): পরিবেশে খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ককে যখন শৃঙ্খল আকারে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে খাদ্য শৃঙ্খল বলে। খাদ্য শৃঙ্খলে শক্তির প্রবাহ একমুখী। উৎপাদক থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বিভিন্ন স্তরের খাদকের মধ্যে শক্তি প্রবাহিত হয়।
উদাহরণ:
ঘাস → ঘাসফড়িং → ব্যাঙ → সাপ → বাজপাখি।
শ্যাওলা → ছোট মাছ → বড় মাছ → বক।
উদ্ভিদ → হরিণ → বাঘ।
খাদ্য জাল (Food Web): পরিবেশে একাধিক খাদ্য শৃঙ্খল যখন জালের মতো বিন্যস্ত থাকে এবং একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকে, তখন তাকে খাদ্য জাল বলে। খাদ্য জালে শক্তির প্রবাহ জটিল ও বহুমুখী। পরিবেশে বিভিন্ন খাদ্য শৃঙ্খল এককভাবে অবস্থান না করে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত থেকে খাদ্য জাল গঠন করে।
৫. পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষায় জীবদের ভূমিকা:
পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সকল জীবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশে বিভিন্ন জীবের সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে।
উৎপাদক: সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করে, পরিবেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে, এবং খাদ্য শৃঙ্খলের ভিত্তি স্থাপন করে।
তৃণভোজী প্রাণী: উদ্ভিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য যোগায়।
মাংসাশী প্রাণী: তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে শক্তির প্রবাহ বজায় রাখে।
মৃতজীবী প্রাণী: মৃত জীবদেহ পচিয়ে পরিবেশে পুষ্টি উপাদান ফিরিয়ে দেয়, যা আবার উৎপাদকেরা গ্রহণ করে।
পরজীবী: বিভিন্ন প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে।
৬. মানুষ ও পরিবেশ:
মানুষ পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে।
পরিবেশ দূষণ: কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের ধোঁয়া, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশ দূষণ করে, যা জীবের জন্য ক্ষতিকর।
বনভূমি ধ্বংস: মানুষ বনভূমি কেটে বসতি স্থাপন, চাষাবাদ, ও শিল্পকারখানা তৈরি করছে, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং জীবের আবাসস্থল ধ্বংস করছে।
৭. পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের করণীয়:
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত:
- পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে।
- বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে।
- জল ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে।
- প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে হবে এবং যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।
- জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
- পরিবেশ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
উপসংহার:
পরিবেশ ও জীবজগৎ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশে প্রতিটি জীবেরই নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমাদের সকলকে পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ বাঁচলে আমরা বাঁচবো।