সপ্তম শ্রেণির প্রথম অধ্যায় ইতিহাসের ধারণা-সারাংশ

সপ্তম শ্রেণির অতীত ও ঐতিহ্য বিষয় অর্থাৎ ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ের বিষয় হল ইতিহাসের ধারণা।  এই অধ্যায়ের মুল বিসয়বস্ত নিচে দেওয়া হল।

গল্প শুনতে আমরা সকলেই ভালোবাসি, বিশেষ করে পুরনো দিনের গল্প। কিন্তু অনেক ইতিহাস বইতে সেই গল্পের আমেজ পাওয়া যায় না। সেখানে শুধু রাজা-উজিরের নাম, যুদ্ধের সাল-তারিখ থাকে। ফলে ইতিহাস পড়াটা অনেকের কাছেই একঘেয়ে লাগে। নাম মনে থাকে না, সাল গুলিয়ে যায়, কে কার পরে সিংহাসনে বসেছেন তা মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

তবে কিছু নাম ও সাল মনে রাখা প্রয়োজন। ইতিহাসের ঘটনাগুলি অনেক বছর আগে ঘটেছিল, এবং সেগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘটেছিল। তাই কোন ঘটনা কোন সময়ে ঘটেছিল তা জানার জন্য সময়কাল জানা দরকার। ইতিহাসে সময় মাপার জন্য তারিখ, মাস, সাল, শতাব্দী, সহস্রাব্দ—এসব ব্যবহার করা হয়। সেকেন্ড, মিনিট বা ঘণ্টার হিসাব এখানে তেমন কাজে লাগে না। সাল-তারিখ জটিল হলেও সময়ের গোলমাল এড়াতে এগুলো প্রয়োজন।

কিছু নাম ও উপাধি খুব কঠিন হতে পারে, যেমন ‘গঙ্গাইকোণ্ডচোল’ বা ‘সকলোত্তরপথনাথ’, অথবা ‘ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বখতিয়ার খলজি’। এই নামগুলি অনেক আগের মানুষের, এবং সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী এমন বড় নাম ও উপাধি প্রচলিত ছিল। বাবর, আকবরের মতো ছোট নাম সহজেই মনে থাকে।

শক্ত নাম হলেও, যেমন দন্তিদুর্গ, তাকে ছোট করে দন্তি বা দুর্গ বলা যায় না। শুধু নাম বা সাল মনে রাখলেই ইতিহাস জানা হয় না। ইতিহাস জানা বলতে বোঝায় বছরের পর বছর ধরে ঘটা নানান ঘটনা ও মানুষের কাজকর্মের কারণ ও ফলাফল বোঝার চেষ্টা করা। অতীতের অনেক ঘটনার ছাপ আজও আমাদের চারপাশে রয়েছে। সেইসব ঘটনা সম্পর্কে ধারণা তৈরির জন্যই ইতিহাস পড়া দরকার।

ইতিহাস জানার রকমফের

পুরোনো দিনের জিনিস, যেমন ঘর-বাড়ি, মন্দির-মসজিদ, মূর্তি, টাকা-পয়সা, ছবি, বইপত্র—এগুলি ইতিহাসের উপাদান। এগুলি থেকে আমরা অতীতের নানান তথ্য জানতে পারি। তবে অনেক উপাদানই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই একটানা ইতিহাস জানা যায় না। ঐতিহাসিকরা ভাঙাচোরা উপাদান খুঁজে জুড়ে অতীতের ধারণা তৈরি করেন। যেখানে উপাদান পাওয়া যায় না, সেখানে ফাঁক থেকে যায়।

উপাদান দিয়ে ইতিহাসের ফাঁক ভরার সময় সাবধান থাকতে হয়। সময় ও জায়গার পরিবর্তনে কথার মানে বদলে যায়। যেমন, সুলতানি বা মুঘল যুগে ‘বিদেশি’ বলতে শুধু অন্য দেশের লোক নয়, বরং গ্রাম বা শহরের বাইরের যে কোনো লোককেই বোঝাতো। ‘দেশ’ বলতেও অনেকে তাদের আদি বাড়ি বোঝেন, যা একটি রাজ্যের মধ্যে একটি অঞ্চল মাত্র। তাই ইতিহাস পড়ার সময় কোন সময়ে কোন অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে তা বোঝা জরুরি।

এই বইতে প্রায় হাজার বছরের ভারতের ইতিহাস আলোচনা করা হবে, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। এই সময়ে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, আবার কিছু মিলও ছিল। কোনো পরিবর্তনই রাতারাতি ঘটেনি, বরং ধীরে ধীরে হয়েছে।

হিন্দ, হিন্দুস্তান, ইন্ডিয়া

  • খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস প্রথম ‘ইন্ডিয়া’ নামটি ব্যবহার করেন। তিনি পারসিক লেখাপত্র থেকে ভারত সম্পর্কে জেনেছিলেন।
  • উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু নদীর ব-দ্বীপ এলাকা পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এর নাম হয় ‘হিদুষ’। ইরানি ভাষায় ‘স’ এর উচ্চারণ না থাকায় ‘হ’ হয়।
  • গ্রিক ভাষায় ‘হ’ এর উচ্চারণ না থাকায় ‘ই’ হয়, তাই হিদুষ থেকে হয় ‘ইন্ডিয়া’। প্রথমে এই শব্দটি শুধু সিন্ধু ব-দ্বীপ এলাকা বোঝাত, পরে পুরো উপমহাদেশ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
  • ‘হিন্দুস্তান’ নামটি আরবি-ফারসি ভাষায় পাওয়া যায়। ২৬২ খ্রিস্টাব্দে খোদিত ইরানের সাসানীয় শাসকের একটি শিলালেখতে এই শব্দটি পাওয়া যায়। দশম শতকের শেষভাগে ‘হুদুদ অল্ আলম’ গ্রন্থে ‘হিন্দুস্তান’ দ্বারা সমগ্র ভারতকে বোঝানো হয়েছে।

ইতিহাসের গুণ-ভাগ

  • দিনকে ঘণ্টা, মিনিটে ভাগ করা গেলেও, হাজার বছরকে ভাগ করার জন্য ‘যুগ’ ব্যবহার করা হয়। সাধারণভাবে ইতিহাসকে ‘প্রাচীন’, ‘মধ্য’ ও ‘আধুনিক’ যুগে ভাগ করা হয়। এখানে যে হাজার বছরের কথা বলা হয়েছে, তা মধ্যযুগের অন্তর্গত। তবে যুগের সীমারেখা টানা যায় না, কারণ এক যুগ হঠাৎ করে শেষ হয়ে অন্য যুগ শুরু হয় না।
  • যেমন, দুপুর না সকাল না বিকেল। তেমনই ভারতের ইতিহাসে একটি সময় ছিল যখন প্রাচীন যুগ শেষ হয়ে আসছিল এবং মধ্যযুগ পুরোপুরি শুরু হয়নি। এই সময়কে বলা হয় আদি-মধ্যযুগ।
  • মানুষের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, দেশশাসন, যুদ্ধ, পড়াশোনা—এসবের বিশেষ দিকের তফাত থেকে যুগ ভাগ করা হয়। আগে বলা হতো মধ্যযুগে মানুষের জীবন অন্ধকারে ডুবে ছিল, কোনো উন্নতি হয়নি। কিন্তু এখন ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন উপাদান থেকে জানতে পেরেছেন যে সেই সময়েও ভারতের মানুষের অনেক উন্নতি হয়েছিল।
  • নতুন যন্ত্র ও কৌশলের ব্যবহার, যেমন কুয়ো থেকে জল তোলা, তাঁত বোনা বা যুদ্ধের অস্ত্র—বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছিল। নতুন খাবার ও পানীয়, যেমন আলুর ব্যবহার শুরু হয় পোর্তুগিজদের মাধ্যমে।
  • দেশ শাসনেও নতুন দিক দেখা যায়, শুধু রাজ্য বিস্তার নয়, জনগণের কথাও শাসকদের ভাবতে হয়। অর্থনীতিতে কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল প্রধান। নতুন শহর তৈরি হয় এবং বন কেটে চাষবাস শুরু হয়।
  • শিল্প ও সাহিত্যে সাধারণ মানুষের কথা খুব বেশি ছিল না, বেশির ভাগই শাসকের গুণগানে ভরা ছিল। যেমন, চোল রাজারা মন্দির বানিয়েছেন বা সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানিয়েছেন। কিন্তু এইগুলি যারা বানিয়েছেন, সেই অসংখ্য কারিগর ও শিল্পীর নাম আমরা জানি না।

ইতিহাসের গোয়েন্দা

গোয়েন্দা গল্পের মতো ইতিহাসেও সূত্র খুঁজে বের করতে হয়। ঐতিহাসিকও একজন গোয়েন্দার মতো, যিনি টুকরো টুকরো সূত্র খুঁজে যুক্তি দিয়ে বিচার করেন এবং অতীতের ঘটনা তুলে ধরেন। যেখানে সূত্র পাওয়া যায় না, সেখানে ফাঁক থেকে যায়।

এই বইটি পড়ার সময় তোমরাও এক একজন ঐতিহাসিক বা গোয়েন্দা হয়ে উঠবে। সূত্রগুলি খুঁটিয়ে দেখবে এবং যুক্তি দিয়ে ফাঁক ভরাট করার চেষ্টা করবে। নতুন সূত্র খোঁজার চেষ্টা করবে। তাহলে ইতিহাস পড়া আরও মজার হয়ে উঠবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top