সপ্তম শ্রেণীর ভূগোলে নদীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত জীবনচক্র, ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয় কাজ, বিভিন্ন ভূমিরূপের সৃষ্টি এবং মানবজীবনে নদীর অপরিহার্য ভূমিকা ও পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ।
ভূমিকা: নদী – আমাদের জীবনরেখা
নদী শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, এটি আমাদের পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানবসভ্যতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সপ্তম শ্রেণীর ‘আমাদের পৃথিবী’ বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা নদীর উৎপত্তি, তার গতিপথের বিভিন্ন পর্যায়, ভূমিরূপ পরিবর্তনে তার ভূমিকা এবং মানবজীবনে নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
নদীর জন্ম ও যাত্রাপথ
নদী হল একটি স্বাভাবিক প্রবহমান জলধারা, যা অভিকর্ষের টানে ভূমির ঢাল অনুসারে উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানের দিকে প্রবাহিত হয়। নদীর যাত্রাপথ শুরু হয় তার ‘উৎস’ থেকে, যা সাধারণত পাহাড়-পর্বত বা মালভূমির মতো কোনো উঁচু জায়গায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের প্রধান নদী গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের ‘গোমুখ’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদী তার প্রবাহ শেষে কোনো সাগর, উপসাগর, হ্রদ বা অন্য কোনো নদীতে গিয়ে মিলিত হয়, সেই স্থানটিকে বলা হয় নদীর ‘মোহনা’। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে গঙ্গা নদীর মোহনা অবস্থিত।
নদীর অববাহিকা ও জলবিভাজিকা
নদীর জলধারা অসংখ্য ছোটো ছোটো জলধারা (উপনদী) থেকে পুষ্ট হয়, যা একটি বৃহৎ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই সম্পূর্ণ অঞ্চলটিকে নদীর ‘ধারণ অববাহিকা’ বলা হয়। পৃথিবীর বৃহত্তম নদী অববাহিকা হলো আমাজন নদী অববাহিকা। দুটি পাশাপাশি প্রবাহিত নদীর ধারণ অববাহিকাকে যে উঁচু ভূমিভাগ পৃথক করে, তাকে ‘জলবিভাজিকা’ বলে। যেমন, পাহাড়ের চূড়া বৃষ্টির জলকে বিভিন্ন দিকে ভাগ করে দেয়।
নদীর প্রধান কাজ: ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয়
নদী তার জলস্রোতের শক্তি ব্যবহার করে তিনটি প্রধান কাজ করে, যা ভূমিরূপ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে:
- ক্ষয়কাজ (Erosion): নদীর প্রবল স্রোতের ধাক্কায় মাটি, বালি, নুড়ি এবং এমনকি বড়ো বড়ো পাথরও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় এবং নদীর তলদেশ ও পার্শ্বদেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
- বহনকাজ (Transportation): ক্ষয়প্রাপ্ত নুড়ি, বালি, পলি, কাঁকর প্রভৃতি পদার্থ নদীর স্রোতের সঙ্গে উৎস থেকে মোহনার দিকে বয়ে চলে।
- সঞ্চয়কাজ (Deposition): যখন নদীর স্রোত কমে যায় (সাধারণত সমভূমি বা নিম্নপ্রবাহে), তখন বয়ে আনা পদার্থগুলো নদীর পাশে বা নদীর মধ্যে জমা হতে থাকে, যা সঞ্চয়কাজ নামে পরিচিত।
নদীর এই তিনটি কাজ নদীর জলের পরিমাণ, গতিবেগ এবং ভূমির ঢালের ওপর নির্ভর করে। শক্তি বেশি থাকলে নদী বেশি ক্ষয় ও বহন করে, আর শক্তি কমলে বেশি সঞ্চয় করে।
নদীর প্রবাহের দশা: উচ্চ, মধ্য ও নিম্নপ্রবাহ
নদীর জীবনচক্রকে তিনটি প্রধান দশায় ভাগ করা যায়, যা মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গে তুলনীয়:
- উচ্চপ্রবাহ (যৌবন দশা): উৎস থেকে সমতলভূমিতে নামার আগ পর্যন্ত নদীর এই দশা থাকে। এখানে ভূমির ঢাল ও বন্ধুরতা বেশি হওয়ায় নদীর শক্তি প্রবল থাকে এবং প্রধান কাজ হয় ক্ষয়। এই প্রবাহে সরু ও গভীর ‘V’ বা ‘I’ আকৃতির উপত্যকা (গিরিখাত বা ক্যানিয়ন) এবং জলপ্রপাত গঠিত হয়। উপনদীর সংখ্যা কম থাকে।
- মধ্যপ্রবাহ (পরিণত দশা): পার্বত্য অঞ্চলের পর মালভূমি বা সমভূমি অঞ্চলে নদীর এই দশা দেখা যায়। ভূমির ঢাল কম হওয়ায় নদীর গতি ও শক্তি কমে আসে। নদী নীচের দিকে ক্ষয় করা কমিয়ে দু-পাশের দিকে ক্ষয় করতে থাকে, ফলে উপত্যকা চওড়া হয়। নদী আঁকাবাঁকা পথে (মিয়েন্ডার) প্রবাহিত হয় এবং চড়া, নদী-দ্বীপ ও অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ গঠিত হয়। প্রধান কাজ বহন ও সঞ্চয়।
- নিম্নপ্রবাহ (বার্ধক্য দশা): উচ্চ ও মধ্যপ্রবাহের পর অত্যন্ত মৃদু ভূমিঢালের ওপর দিয়ে নদী মোহনা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। এই দশায় নদীর গতি ও শক্তি প্রায় ফুরিয়ে যায় এবং প্রধান কাজ হয় সঞ্চয়। শাখানদী সৃষ্টি হয় এবং পলি জমে নদী অগভীর হয়ে যায়। বন্যার সময় উর্বর প্লাবনভূমি এবং মোহনার কাছে ব-দ্বীপ (যেমন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপ) গঠিত হয়।
মানবজীবনে নদীর গুরুত্ব ও পরিবেশগত প্রভাব
নদী মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই জীবনরেখা হিসেবে কাজ করেছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল। বর্তমানেও নদীমাতৃক দেশগুলিতে নদী কৃষি, পানীয় জল, পরিবহন, মৎস্য আহরণ এবং পর্যটন শিল্পের জন্য অপরিহার্য। উর্বর পলিমাটির সমভূমিগুলি বিশ্বের অন্যতম জনবহুল অঞ্চল।
তবে, মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ নদীর স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট করছে। কৃষি ব্যবস্থার প্রসার, শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং অপরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাশন নদীর জলকে দূষিত করছে। বাঁধ নির্মাণ, অতিরিক্ত সেচ এবং শিল্প বর্জ্য নদীর প্রবাহ, পলি পরিবহন এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করছে, যা বন্যা, নদী শুকিয়ে যাওয়া এবং জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। নদীর দূষণ রোধে সচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার
নদী শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়, এটি আমাদের পৃথিবীর জীবন্ত ধমনি। এর গতিশীল প্রক্রিয়াগুলি ভূমিরূপের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করে। নদীর সঠিক পরিচর্যা ও সংরক্ষণ একটি সুস্থ পরিবেশ ও টেকসই সভ্যতার জন্য অপরিহার্য।